[এসএস'কে নিয়ে এ পর্যন্ত কম লেখা হয়নি। বেশীরভাগ লেখাই কোনো দলীয়স্বার্থ পূরণের জন্য। অনেকে ব্যক্তি এসএস'র জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করে তার বিপ্লবীত্বকে খাটো করেছেন। কেউ তাকে 'ভুল/বেহাত বিপ্লব'এর দোসর বলেই মূল্যায়নটি শেষ করতে চান। এই সব দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বলে লেখার শিরোনামে 'অন্য আলোয় দেখা' কথাটি যুক্ত করা হয়েছে। এটি মোটেই এসএস'র কর্মকাণ্ডের সামগ্রীক মূল্যায়ন নয়। এটি ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে নির্মোহভাবে এই শহীদ দেশপ্রেমিক বিপ্লবীকে দেখার একটি ছোট্ট প্রয়াস।]
আর কয়েকটা শত্রু খতম হলেই তো গ্রামগুলো আমাদের/ জনগণ যেনো জল, গেরিলারা মাছের মতো সাঁতরায়...: সিরাজ সিকদার।
অস্ত্র কোনো নির্ধারক শক্তিনয়, নির্ধারক শক্তি হচ্ছে মানুষ। সংগঠিত জনগণ অ্যাটম বোমার চেয়েও শক্তিশালী।:মাওসেতুং।
সর্বহারা পার্টি গঠন, ১৯৭১গেরিলা যুদ্ধের মহানায়ক মাওসেতুং-এর নেতৃত্বে চীনের বিপ্লব ও চীনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছয়ের দশকের শেষভাগে সারা বিশ্বের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো যুদ্ধোপূর্ব বাংলাদেশেও। পাকিস্তানী শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট, অগ্নিগর্ভ পূর্ব বাংলাকে বেশ কয়েকটি বামপন্থী গ্রুপ সশস্ত্র পন্থায় মুক্ত করতে চেয়েছিলো।
এ সময় পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও বিকশিত হতে থাকে জাতীয় মুক্তির প্রশ্ন। পাকিস্তানপর্বে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় কমিউনিস্ট পার্টি মূলত আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মধ্যে মিশে গিয়ে কাজ করতে থাকে। পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক বছরের মধ্যেই বাঙালিদের স্বপ্নভঙ্গ হতে থাকে। এ পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থীরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার নানা প্রক্রিয়া হাতে নেয়। এ সময় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও জমে ওঠে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নামে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয় লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ও তাঁর সঙ্গীদের। মামলার শেষ পর্যায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অন্যদিকে ১৯৬৭ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ির ফাশিদেওয়া, নকশালবাড়ীতে ঘটে যায় এ সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পথ হিসেবে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ নেয় চারু মজুমদারের নেতৃত্বে একদল কমিউনিস্ট। পরে যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-- সিপিআই (এমএল) নামে পার্টি তৈরি করেছিলেন, যা ভারতীয় উপমহাদেশে নকশাল আন্দোলন নামে পরিচিত হয়েছিল। নকশালবাড়ীর সেই প্রবল জোয়ার পূর্ব পাকিস্তানেও আছড়ে পড়ে।
পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি আগেই রুশ ও চীন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একটি ধর্মভিত্তিক বৈরী রাজনৈতিক আবহাওয়ায় কমিউনিস্ট হিসেবে রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের পথ তখন সহজ ছিল না, খুব কম লোকই সেই পথে এগোতে পেরেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলনে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র সিরাজুল হক সিকদার বা সিরাজ সিকদার। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের ছাত্র বুয়েটের লিয়াকত হল শাখার সভাপতি সিরাজ সিকদার ওই বষয়েই পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) সদস্যপদ ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) চারু মজুমদারের সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের তত্ত্বকে হঠকারী হিসেবে আখ্যায়িত করল। এর প্রতিক্রিয়ায় পার্টি থেকে বেরিয়ে আসেন সিরাজ সিকদার।
এই উত্তাল পরিস্থিতিতে তরুন বিপ্লবী সিরাজ সিকদার প্রথমে মাওসেতুং গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি পাঠচক্রের মাধ্যমে শিক্ষিত ও বিপ্লব আকাঙ্খী যুবকদের সংগঠিত করেন। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি গঠন করেন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন। প্রতিষ্ঠার পরেই এ গ্রুপটির মূল থিসিস ছিলো: পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ এবং ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের’ মাধ্যমে এ উপনিবেশের অবসান ঘটাতে হবে। এ লক্ষ্যে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয়।
ছয়-দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
অন্যদিকে পিকিংপন্থী পূর্ব বাংলার কমিউন্স্টি পার্টির নেতৃত্বে ছিলো দুটি ভাগ। একটি অংশ টিপু বিশ্বাস ও দেবেন সিকদার মুক্তিযুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। অন্যদিকে মতিন-আলাউদ্দীনের দল ‘দুই শ্রেণী শত্রু’ মুক্তিবাহিনী ও পাক-বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার পক্ষপাতি ছিলো। এ পার্টির নেতারা রাজশাহীর আত্রাই অঞ্চলে ছিলো বেশ তৎপর।
অন্যদিকে পিকিংপন্থী পূর্ব বাংলার কমিউন্স্টি পার্টির নেতৃত্বে ছিলো দুটি ভাগ। একটি অংশ টিপু বিশ্বাস ও দেবেন সিকদার মুক্তিযুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। অন্যদিকে মতিন-আলাউদ্দীনের দল ‘দুই শ্রেণী শত্রু’ মুক্তিবাহিনী ও পাক-বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার পক্ষপাতি ছিলো। এ পার্টির নেতারা রাজশাহীর আত্রাই অঞ্চলে ছিলো বেশ তৎপর।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ এই বিপ্লবী পরিষদ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লেখে, যা লিফলেট আকারে সারাদেশে প্রচার করা হয়। এতে স্পষ্ট লেখা হয়:
আপনার ও আপনার পার্টির ছয় দফা সংগ্রামের রক্তাক্ত ইহিতাস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে, ছয় দফার অর্থনৈতিক দাবিসমূহ বাস্তবায়ন সম্ভব সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যমে, পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্ত ও স্বাধীন করে। আপনাকে ও আপনার পার্টিকে পূর্ব বাংলার সাত কোটি জনসাধারণ ভোট প্রদান করেছে পূর্ব বাংলার উপরস্থ পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকগোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের অবসান করে স্বাধীন ও সার্বভৌম পূর্ব বাংলা কায়েম করার জন্য। পূর্ব বাংলার জনগণের এ আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন আপনার প্রতি ও আওয়ামী লীগের প্রতি নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলো পেশ করছে :(এরপর ৬ নম্বর পয়েন্টে শ্রমিক আন্দোলনের খোলা চিঠিতে ১৩টি করণীয় নির্ধারণ করে। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে জমি বণ্টন, শ্রমিকদের শ্রম শোষণ বন্ধ, ভাষাগত, ধর্মীয়, জাতিগত সংখ্যালঘুদের সম-অধিকার দেওয়ার বিধানসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা হাজির করে)।
১. পূর্ব বাংলার নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এবং সংখ্যাগুরু জাতীয় পরিষদের নেতা হিসেবে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করুন।
২. পূর্ব বাংলার কৃষক-শ্রমিক, প্রকাশ্য ও গোপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি-সংবলিত স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী সরকার কায়েম করুন।
৩. পূর্ব বাংলাব্যাপী এ সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানান। এ উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনী গঠন এবং শহর ও গ্রামে জাতীয় শত্রু খতমের ও তাদের প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের আহ্বান জানান।
৪. পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার জন্য শ্রমিক-কৃষক এবং প্রকাশ্য ও গোপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে 'জাতীয় মুক্তি পরিষদ' বা 'জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট' গঠন করুন।
৫. প্রকাশ্য ও গোপন, শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র, সংস্কারবাদী ও বিপ্লবী পদ্ধতিতে সংগ্রাম করার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
কিন্তু আওয়ামী নেতারা সিরাজ সিকদারের এই আহ্বান উপেক্ষা করেন, যা পরে গড়ায় দুই পার্টির এক রক্তাক্ত ইতিহাসে।
১৯৭০ সালে সিরাজ সিকদারের বিপ্লবী পরিষদ বিভিন্ন জেলায় পাকিস্তানী প্রশাসন ও শ্রেনী শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা অপারেশন চালায়। ওই বছরের ৮ জানুয়ারি তারা ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ ও ময়মনসিংহে ওড়ায় স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা।
পাকিস্তানী বাহিনীর আকস্মিক হামলার পর সিরাজ সিকদার বরিশালের পেয়ারা বাগানে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ যুদ্ধ। ৩০ এপ্রিল জন্ম নেয় জাতীয় মুক্তিবাহিনী। রণকৌশল নির্ধারণ ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সিরাজ সিকদারের সভাপতিত্বে প্রতিষ্ঠা হয় ‘সর্বোচ্চ সামরিক পরিচালনা কমিটি’। ৩ জুন পার্টির নতুন নাম দেয়া হয়: পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি।
বরিশাল থেকে শুরু করে দেশের কয়েকটি উপকূলীয় অঞ্চল–বিক্রমপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকায় সর্বহারা পর্টির গেরিলারা পাক-বাহিনীর সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে।
সে সময় সর্বহারা পার্টি শত্রুমুক্ত এলাকায় (মুক্তাঞ্চল) বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনার জন্য বেশ কিছু পর্ষদ গঠন করে। কিন্তু এই সময় সিরাজ সিকদার ত্রি-মুখী লড়াইয়ের রণ কৌশল ঘোষণা করেন, যাতে সর্বহারা পার্টি ব্যপক লোকবল হারায়। আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে মুজিব বাহিনী ও সর্বহারা পার্টির মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বেশ কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়।
এমনই পরিস্থিতিতে অক্টোবরে সর্বহারা পার্টি দলের গেরিলাদের নির্দেশ দেয় পাক-বাহিনী, ভারতীয় বাহিনী ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে। কারণ সিরাজ সিকদার পাকিস্তানকে উপনিবেশবাদী , ভারতকে অধিপত্যবাদী এবং আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
নভেম্বরের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সর্বহারা পার্টির বহু সদস্য নিহত হয়েছিলো।
নকশালী মূল্যায়ন: আই অ্যাম দা পার্টি!১৯৬৬ সালের চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটি বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে দুই বাংলায়। ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও’ মাওসেতুং এর এই দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ, তথা সশস্ত্র কৃষক বিপ্লবের রনোনীতি গ্রহণ করে যুদ্ধপূর্ব সময়ের বামপন্থী দলগুলোর একাংশ। সাধারণভাবে এসব বামদলগুলো পিকিংপন্থী (পরে নকশাল) হিসেবে চিহ্নিত হয়। এরই একটি পূর্ব বাংলার কমিউন্স্টি পার্টি; এই পার্টির নেতৃত্বে ছিলো আবার দুটি ভাগ। একটি অংশ টিপু বিশ্বাস ও দেবেন সিকদার মুক্তিযুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তারা ১৯৭১ সালে রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গ এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে তোলেন পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ। তবে স্পষ্টতই এর বেশীরভাগ প্রতিরোধ যুদ্ধই পরিচালিত হয় মুজিব বাহিনীর বিরুদ্ধে।
এর আগে অগ্নিগর্ভ যুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশে ১৯৬৯-৭০ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর ন্যাপের নেতৃত্বে লাল টুপির সম্মেলন এবং সন্তোষ কৃষক সম্মেলনেও পিকিংপন্থী নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (দেবেন সিকদার) কেন্দ্রীয় নেতা আজিজ মেহের ১৯৬৯ সালে সার্বক্ষনিক কর্মী হিসেবে পার্টির ঢাকা, ময়মনসিংহ ও বরিশাল আঞ্চল তদারকির দায়িত্ব পালন করেন। এরই মধ্যে ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের নয়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে সারাদেশে সামরিক আইন জারী করেছেন।
প্রকাশ্য রাজনীতি ছেড়ে আত্নগোপনে থেকেই পার্টির নেতারা চেষ্টা করলেন মাওবাদী ছোট ছোট গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার। মূল দায়িত্ব দেয়া হলো আজিজ মেহেরকে। বরিশালে একজন অ্যাডভোকেটের নেতৃত্বাধীন গ্রুপের সঙ্গে আজিজ মেহেরের প্রথম দফা বৈঠক অসফল হয়। পরে মাওপন্থী ছাত্রদের একটি গ্রুপ তাদের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্নতা প্রকাশ করে পার্টিতে যোগ দেয়। এর পর ঐক্যের ডাক নিয়ে আজিজ মেহের সাক্ষাৎ করেন সর্বহারা পার্টির প্রধান সিরাজ সিকদারের সঙ্গে।
বাকী কথা আজিজ মেহেরের ভাষ্যে:
…একটি গ্রুপ কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে তখন বিকশিত হচ্ছে ঢাকায় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। যদিও তার সম্পর্কে বামপন্থী-বুদ্ধিজীবী মহলে নানা বিভ্রান্তি। কেউ মনে করতেন, এরা অ্যাডভেঞ্চারিস্ট, সন্ত্রাসবাদী; কেউ মনে করতেন, সিরাজ সিকদার হচ্ছেন সিআইএ’র এজেন্ট। তবে আমাদের পার্টি এ বিষয়টি এমন একপেশে, যান্ত্রিকভাবে দেখতো না। আমি মনে করি, কমরেড সিরাজ সিকদারের একটি বিপ্লবী আকাঙ্খা ছিলো। কথাবার্তা, চলাফেরা– সবকিছুর মধ্যে ছিলো একটা আকর্ষণীয় ব্যপার। তরুণ ছাত্রকর্মী, যারা বিপ্লবের জন্য ছিলো ব্যাকুল, তারা সহজেই আকৃষ্ট হয়েছিলো। তারা কয়েকটা গেরিলা গ্রুপ করে, কয়েকটি সরকারি অফিসে বোমাবাজী করে, দেয়াল লিখনে বেশ সাড়া জাগিয়েছিলো। বিশেষ করে সিরাজ সিকদারের থিসিস আকৃষ্ট করেছিলো ছাত্র-তরুণদের।তোমার নাম, আমার নাম/ ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম!সাতের দশকের শুরুতে ওপারে ভারতে চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট) বা সিপিআই (এম-এল) জলপাইগুড়ির নকশালবাড়িতে সফলভাবে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত করে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র একে ‘বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ’ হিসেবে চিহ্নিত করলে চারু মজুমদার পার্টিতে ঘোষণা করেন:
কিন্তু আমরা মনে করতাম, এদের কর্মকাণ্ডে যতটা রোমান্টিক বিপ্লবী উপদান আছে, ততটা মার্কসীয় উপাদান নেই।
তবু অনেক চেস্টার পর ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় কমরেড সিরাজ সিকদারের সঙ্গে আমার দেখা হলো। উনি আমাদের পার্টির দলিলই পড়েননি! তার ব্যাগে দলিল ভড়ে দিলাম। সব শুনে উনি বললেন, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কোনো ইচ্ছা ‘তার বা তার পার্টির’ নেই। কথা শুনে মনে হলো: উনিই পার্টি!
কথাবার্তার সময় সিরাজ সিকদার বার বার তার কোটের পকেট থেকে মাওসেতুং এর লাল বই (কোটেশন ফ্রম মাওসেতুং, রেড বুক হিসেবে সারা বিশ্বে বহুল প্রচারিত) বের করে দু-এক পাতা দেখে নিচ্ছিলেন। ওনার শোল্ডার হোল্ডারে একটা রিভলবার দেখতে পেলাম। সব কিছুই যেনো একটা ‘শো’ বলে মনে হচ্ছিলো।
মনে হলো, উনি একজন উচ্চাকাঙ্খী বামপন্থী নেতা। রোমান্টিক কর্মকাণ্ডের জন্য তার গ্রুপের কিছুটা বিকাশ হয়তো হবে; তার কোনো ভবিষ্যত নেই। আমাদের পার্টির ঐক্য হলো না।…
নকশালবাড়ির পথ ধরেই ভারতে কৃষক বিপ্লব বিদ্রোহ হবে; মাওসেতুং-এর দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের পথই আমাদের পথ; জনযুদ্ধই মুক্তির সদন…
কলকাতার দেওয়ালে লেখা হয়:
নকশালবাড়ি লাল সেলাম!হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী চার মজুমদারের উদাত্ত আহ্বানে বিপ্লবের আগুনে ঝাঁপ দেয়।
চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান!
বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে!
৭০এর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন!
সে সময় নকশালরা সাইকেলের পাইপ কেটে ছড়ড়ার বুলেট ব্যবহার করে হাতে তৈরি সিঙ্গেল শট বন্দুক ‘পাইপগান’ বানায়। আর পুলিশের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া থ্রি নট থ্রি রাইফেলের নল ও কুঁদো ছেটে ছোট আকৃতি দিয়ে তৈরি করা হয় সহজে বহনযোগ্য কাটা-রাইফেল। এছাড়া কাঁচের বোতলের ভেতর আলকাতরা ও পেট্রোলের মিশ্রনে তৈরি হয় মলটোভ বোমা। নকশালবাদী আন্দোলনে গ্রাম ও শহরে ‘শ্রেনী শত্রু খতমের লাইনে’ বিপ্লব করতে এই অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে। সঙ্গে রাম দা তো ছিলোই।
নকশালবাদী আন্দোলনের ঢেউ এপারে মাওপন্থী বাম দলগুলোর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে, এ কথা আগেই বলা হয়েছে। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি সরাসরি চারু মজুমদারের খতমের লাইন গ্রহণ না করলেও নকশালী কায়দায় জনবিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী লাইন, তথা জোতদার নিধন কর্মসূচি চালায়। এপারেও নকশালাইট ও সর্বহারাদের মধ্যে পাইপ গান ও কাটা রাইফল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের পটভূমিতে কবি সুবিমল মিশ্র লিখলেন:
আবার পাইপ গান এতো বেশী গরম হয়ে আসে যে, ক্রমশ এর ব্যবহার কমে আসছে। …
অর্থাৎ মাওবাদী গ্রুপগুলো সাতের দশকে ‘শ্রেণী শত্রু খতমের’ নামে যখন পাইপগানের যথেচ্ছ ও ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে, এমন কী তা দলীয় কোন্দল মেটাতেও ব্যবহার হতে থাকে, তখন তারা আদর্শচ্যূত হয়ে পড়ে। জনযুদ্ধের অস্ত্রের বিপ্লবী ব্যবহার না হয়ে, তা ব্যবহত হতে থাকে গোষ্ঠি বিপ্লবের নামে, কখনো ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষাতেও। …
পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) কেন্দীয় নেতা, নকশালপন্থী আজিজ মেহের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, চারু মজুমদারের মতো এপাড়েও শিক্ষিত তরুণ সমাজ সহজেই সিরাজ সিকদারের বিপ্লবের থিসিসে আকৃষ্ট হয়।
সরকার বিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় আজিজ মেহেরকে আটক করে ব্যপক নির্যাতন করে এবং তাকে সশ্রম কারাদন্ড দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। নতুন রাজনৈতিক বন্দী এবং কয়েকজন বাঙালি জেল পুলিশের বরাতে তিনি তখন দেশের সব খবরাখবরই পেতেন। এমন কী পার্টির নেতাদের সঙ্গেও তার গোপন চিঠিপত্রের লেন দেন চলছিলো।
আজিজ মেহের বলেন,
…ওদিকে কিন্তু ভারতে নকশাল দমনের নামে হাজার হাজার তরুনকে হত্যা করা হচ্ছে; গ্রেফতার করে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশের বামেরা কখনো ডানে, কখনো বামে হেলছেন। কিন্তু তারা প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, শ্রেণী শত্রু খতম করছেন, কখনো মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন। আমরা সব খবরই জেলে বসে বিশেষ চ্যানেলে পেতাম।
এই সময় কিউবায় ফিদেল ক্যাস্ট্রো-চে গুয়েভারার বিপ্লবী আন্দোলন এবং ভিয়েতনামে হো চি মিনের কৃষক বিপ্লব ওপার বাংলা-ওপার বাংলায় তরুনদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো। সারাদেশে শ্লোগান ওঠে:
তোমার নাম, আমার নামএদিকে ১৯৭২-৭৪ মাওবাদী বা পিকিংপন্থী গ্রুপগুলোর মধ্যে সশস্ত্রপন্থার রণোনীতি নিয়ে বিভেদ দেখা দেয়। শিগগিরই শুরু হয়ে যায় পরস্পরকে বহিস্কার ও মৃত্যূদণ্ড ঘোষণা। সিরাজ সিকদার সর্বহারা পার্টিকে নিস্কন্টক রাখতে ‘নিপাত চক্র’ নামে পার্টির ভেতরে একটি অনুগত গ্রুপ করেছিলেন। এদের মূল কাজ ছিলো, পার্টির ভেতরের প্রতিক্রিয়াশীলদের হত্যা করা।
ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম!
আজিজ মেহের জেল খানার জীবনের স্মৃতিচারণ করে বলেন,
…আমাকে নিউ ২০ সেলে স্থানান্তর করা হলো। পাশের সেলে ছিলো বৃহত্তর বরিশালের কাকচিরা গ্রামের ও বরিশাল কলেজের ছাত্র কমরেড সেলিম শাহনেওয়াজ। সে ছিলো সিরাজ সিকদারের পার্টির সদস্য। ১৯৭১ এর পরে ১৯৭৩ এ পার্টির সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় সিরাজ সিকদারের নির্দেশে এই আত্নত্যাগী তরুণকে হত্যা করা হয়। যেমন হত্যা করা হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হুমায়ুন কবিরকে।…যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে শেখ মুজিবের প্রধান রাজনৈতিক শত্রুতে পরিণত হয় মাওপন্থীরা। আজিজ মেহের বলছেন,
(১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর জেল থেকে বেরিয়ে) আমি দ্রুত পার্টি লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম এবং (আত্ম-গোপনের জন্য) ঢাকায় কয়েকটি শেল্টার ঠিক করে ফেললাম। ১৯৭১ সালে আমাদের পার্টি বিশেষ এক অধিবেশনে চারু মজুমদারের নকশালী লাইন গ্রহণ করে। সে সময় তারা শ্রেণীশত্রু খতমের পাশাপাশি পাক-বাহিনীকেও মোকাবিলা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তোয়াহা ও সিরাজ সিকদারের পার্টি একই রকম কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার ও মুজিব বাহিনীর প্রধান টার্গেট ছিলো এই সব গ্রুপ। সারাদেশে ‘ধরো আর মারো’ শুরু হয়ে গেলো। শেখ মুজিব এক জনসভায় ঘোষণা করলেন: নকশাল দেখা মাত্র গুলি করা হবে। মওলানা ভাসানী প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিলেন: নকশাল কারো গায়ে লেখা থাকে না। বিনা বিচারে কাউকে হত্যার অধিকার সরকারের নেই।…
এদিকে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সর্বহারা পার্টি সারাদেশে হরতালর ডাক দেয়। পার্টির মুখপত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’ ও প্রচারপত্রে বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মুজিব সরকারের আত্ম সমর্পণ দিবস। একমাত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমেই জনগণের বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত বিজয় আসতে পারে।
মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মুজিব সরকারের ব্যপক দমন-পীড়ন, হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে সর্বহারা পার্টি ঢাকায় হরতাল আহ্বান করলে সন্তোষ থেকে মওলানা ভাসানী বিবৃতি দিয়ে একে সমর্থন করেন। হরতাল সফল হয়।…
কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?সাতের দশকের নকশাল নেতা আজিজ মেহের বলছেন:
১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সর্বহারা পার্টি সারাদেশে হরতালর ডাক দেয়। পার্টির মুখপত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’ ও প্রচারপত্রে বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মুজিব সরকারের আত্মসমর্পণ দিবস। একমাত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমেই জনগণের বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত বিজয় আসতে পারে। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মুজিব সরকারের ব্যপক দমন-পীড়ন, হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে সর্বহারা পার্টি ঢাকায় হরতাল আহ্বান করলে সন্তোষ থেকে মওলানা ভাসানী বিবৃতি দিয়ে একে সমর্থণ করেন। হরতাল সফল হয়।…সশস্ত্র কার্যক্রমের মুখে মুজিব সরকার নকশাল ও সর্বহারা পার্টি নিধনে ব্যপক তৎপর হয়। সর্বহারা নেতা সিরাজ সিকদার পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্বে ধরা পড়েন। মুজিব সরকার তাকে বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করেন। …এটি ছিলো ১৯৭২-৭৫ এ মাওপন্থী নিধনযজ্ঞের একটি ধারাবাহিকতা মাত্র।
৪ জুন ১৯৯২ সালে সিরাজ সিকদারকে হত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও মোহাম্মদ নাসিমসহ সাতজনকে আসামি করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। সিরাজ সিকদার পরিষদের সভাপতি শেখ মহিউদ্দিন আহমদ বাদী হয়ে এই মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেন : ১. সাবেক পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, ২. আবদুর রাজ্জাক এমপি, ৩. তোফায়েল আহমেদ এমপি, ৪. সাবেক আইজিপি ই এ চৌধুরী, ৫. সাবেক রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান, ৭. মোহাম্মদ নাসিম এমপি গং। আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২ ও ১০৯ নম্বর ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। আর্জিতে বলা হয়:
আসামিরা মরহুম শেখ মুজিবের সহচর ও অধীনস্থ কর্মী থেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও গোপন শলা-পরামর্শে অংশগ্রহণ করতেন এবং ১ নং থেকে ৬ নং আসামি তৎকালীন সময়ে সরকারের উচ্চপদে থেকে অন্য ঘনিষ্ঠ সহচরদের সঙ্গে শেখ মুজিবের সিরাজ সিকদার হত্যার নীলনকশায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা এ লক্ষ্যে সর্বহারা পার্টির বিভিন্ন কর্মীকে হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হয়রানি করতে থাকেন। সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার ও হত্যার বিবরণ দিয়ে আর্জিতে বলা হয়, মরহুম শেখ মুজিব ও উলি্লখিত আসামিরা তাঁদের অন্য সহযোগীদের সাহচর্যে সর্বহারা পার্টির মধ্যে সরকারের চর নিয়োগ করেন। এদের মধ্যে ই এ চৌধুরীর একজন নিকটাত্মীয়কেও চর হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এভাবে ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকা থেকে অন্য একজনসহ সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার করে ওই দিনই বিমানে করে ঢাকায় আনা হয়। ঢাকার পুরনো বিমানবন্দরে নামিয়ে বিশেষ গাড়িতে করে বন্দিদের পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের মালিবাগস্থ অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সিরাজ সিকদারকে আলাদা করে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়।
২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর বিশেষ স্কোয়াডের অনুগত সদস্যরা গণভবনে মরহুম শেখ মুজিবের কাছে সিরাজ সিকদারকে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায়। সেখানে শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলীসহ আসামিরা, শেখ মুজিবের পুত্র মরহুম শেখ কামাল এবং ভাগ্নে মরহুম শেখ মনি উপস্থিত ছিলেন। আর্জিতে আরো বলা হয়, প্রথম দর্শনেই শেখ মুজিব সিরাজ সিকদারকে গালিগালাজ শুরু করেন। সিরাজ এর প্রতিবাদ করলে শেখ মুজিবসহ উপস্থিত সবাই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। সিরাজ সে অবস্থায়ও শেখ মুজিবের পুত্র কর্তৃক সাধিত ব্যাংক ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপকর্ম, ভারতীয় সেবাদাসত্ব না করার, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শেখ মুজিবের কাছে দাবি জানালে শেখ মুজিব আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। সে সময় ১ নং আসামি মাহবুব উদ্দিন তাঁর রিভলবারের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে সিরাজ সিকদার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শেখ কামাল রাগের মাথায় গুলি করলে সিরাজ সিকদারের হাতে লাগে। ওই সময় সব আসামি শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কিল, ঘুষি, লাথি মারতে মারতে তাঁকে অজ্ঞান করে ফেলেন। এর পর শেখ মুজিব, মনসুর আলী এবং ২ থেকে ৭ নং আসামি সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১ নং আসামিকে নির্দেশ দেন। ১ নং আসামি মাহবুব উদ্দিন আহমদ আসামিদের সঙ্গে বন্দি সিরাজ সিকদারকে শেরে বাংলানগর রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে যান। এর পর তাঁর ওপর আরো নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে ২ জানুয়ারি আসামিদের উপস্থিতিতে রাত ১১টার দিকে রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরেই সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে ১ নং আসামির সঙ্গে বিশেষ স্কোয়াডের সদস্যরা পূর্বপরিকল্পনা মতো বন্দি অবস্থায় নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ সাভারের তালবাগ এলাকা হয়ে সাভার থানায় নিয়ে যায় এবং সাভার থানা পুলিশ পরের দিন ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে প্রেরণ করে।
এদিকে বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস ১৯৮৬ সালে ‘বাংলাদেশ: আ লিগেসি অব ব্লাড’ নামক প্রামান্য গ্রন্থে তুলে ধরেন সিরাজ সিকদার হত্যার বিস্তারিত দিক। এর আগে মুজিব সরকারের পতনের পর ১৯৭৬ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এ সংক্রান্ত কিছু সাক্ষাতকারভিত্তিক তথ্য প্রকাশিত হয়।
বলা ভালো, মাসকেরেনহাসই প্রথম সাংবাদিক যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের দি সানডে টাইমস পত্রিকায় তখনকার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পাক-বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের চিত্র তুলে ধরে ধরেন। তার সেই নিবন্ধ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামান্যগ্রন্থ ‘দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ’ সারা বিশ্বে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত তৈরিতে গুরুত্পূর্ণ ভূমিকা রাখে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই সাংবাদিকের ছিলো একে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দীন, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমানসহ শীর্ষ স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ।
‘বাংলাদেশ: আ লিগেসি অব ব্লাড’ গ্রন্থে মাসকেরেনহাস মুজিব হত্যা, তিন জাতীয় নেতা হত্যা, জিয়উর রহমান হত্যাসহ যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নানা নাটকীয় ঘটনা নিজস্ব অনুসন্ধান থেকে বর্ণনা করেন। এ জন্য তিনি শতাধিক সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন।
মাসকেরেনহাস বলছেন:
ঘটনাচক্রে মাওপন্থী সিরাজ সিকদার ১৯৭৪ সালে ডিসেম্বরের শেষ দিকে চট্টগ্রামের কাছাকাছি এক এলাকা থেকে (টেকনাফ) শেষ পর্যন্ত পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হলেন।
জাকারিয়া চৌধুরির (সিরাজ সিকদারের ছোটবোন, ভাস্কর শামীম সিকদারের স্বামী) মতে, তাকে পাহারা দিয়ে ঢাকায় আনা হলো শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করানো জন্য। শেখ মুজিব তাকে তার আয়ত্বে আনতে চাইলেন। কিন্তু সিকদার কোনো রকম আপোষ রফায় রাজী না হলে মুজিব পুলিশকে ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ গ্রহণ করতে বলে দিলেন।
জাকারিয়া বললো, সিরাজ সিকদারকে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ-বাঁধা অবস্থায় রমনা রেস কোর্সের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। তারপর (২ জানুয়ারি ১৯৭৫) গভীর রাতে এক নির্জন রাস্তায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই সময় সরকারি প্রেসনোটে বলা হয় যে, ‘পালানোর চেষ্টাকালে সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
সিকদারের বোন, জাকারিয়ার স্ত্রী শামীম জানায়, সিরাজের দেহের গুলির চিহ্ন পরিস্কার প্রমাণ করে যে, স্টেনগান দিয়ে তার বুকে ছয়টি গুলি করে তাকে মারা হয়েছিলো।
সিরাজ সিকদারকে, শেখ মুজিবের নির্দেশেই হত্যা করা হয়েছে বলে সারাদেশে রটে গেলো।
১৯ বছরের যুবতী শামীম তার ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
সে আমাকে বলেছিলো, আমি সর্বহারা পার্টির কাছ থেকে একটা রিভলবার পেয়েছিলাম এবং এই হত্যাকারীকে হত্যা করার সুযোগের সন্ধান করছিলাম।
শামীম বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ভাস্করদের একজন। গত বছরই কেবল সে তার ভাস্কর্যের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করে। তার ধারণা, সে নিশ্চয়ই মুজিবকে গুলি করার দূরত্বে পেয়ে যাবে।
শামীম মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য বহুবার আর্জি পেশ করেছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে সে। তারপর সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের কলা বিভাগে তার এক প্রদর্শনীতে শেখ মুজিবকে আমন্ত্রণ জানালো। মুজিব আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সেখানে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হলেন।
সে স্মৃতিচারণ করে বললো, আমি ভায়নক বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম। আমি শত চেষ্টা করেও তাঁকে (শেখ মুজিব) আমার গুলির আয়ত্বে আনতে পারলাম না।
ভাগ্যই মুজিবকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। শামীম জাকারিয়ার প্রেমে পড়ে যায়। শেষে তাদের বিয়ে হলে স্বামীর সঙ্গে শামীম বিদেশে চলে যায়।
এদিকে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশন বসে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করানোর পর তার দ্বিতীয় বিপ্লব, বাকশাল প্রসঙ্গে শেখ মুজিব অধিবেশনে বলেন:
স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর যারা এর বিরোধীতা করেছে, যারা শত্রুর দালালী করেছে, কোনো দেশেই তাদের ক্ষমা করা হয় নাই। কিন্তু আমরা করেছি। আমরা তাদের ক্ষমা করে দিয়ে বলেছি, দেশকে ভালোবাসো। দেশের স্বাধীনতা মেনে নাও। দেশের কাজ করো। কিন্তু তারপরও এদের অনেকে শোধরায়নি। এরা এমনকি বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে বিদেশ থেকে টাকা নিচ্ছে। ওরা ভেবেছে, আমি ওদের কথা জানি না! একজন রাতের আঁধারে মানুষ মেরে যাচ্ছে, আর ভাবছে তাকে কেউ ধরতে পারবে না। কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? তাকে যখন ধরা গেছে, তখন তার সহযোগীরাও ধরা পড়বে।…এরপর মুজিব, জিয়া ও এরশাদ সরকারের দমননীতির ভেতর সর্বাহারা পার্টি বহু ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর বেশীরভাগ উপদলই আদর্শহীন সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিনত হয় মাত্র– সে ইতিহাস সবার জানা।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফজতে মৃত্যু/বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড/ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার/ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার প্রশ্নে সিরাজ সিকদারই প্রথম রাজনৈতিক নেতা কি না, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম এমন রাষ্ট্রীয় খুনের শিকার হলেন–এ বিষয়টিও এসে যায়।
তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বাংদেশের সঠিক ইতিহাস রচনায় শুধু শেখ মুজিব, চার জাতীয় নেতা বা জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচারই শুধু যথেষ্ট নয়, শহীদ দেশ প্রেমিক বিপ্লবী সিরাজ সিকদার, কর্নেল তাহের, চলেশ রিছিলসহ সব রাজনৈতিক হত্যার বিচার হওয়া জরুরি।
অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস তার ওই বইটির শেষ বাক্যে যেমন বলেন,
দুরভিসন্ধী আর হত্যা, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছে। এক হত্যা আরেক হত্যাকে তরান্বিত করেছে, দেশকে আবদ্ধ করেছে এক রক্তের ঋণে।…
তবে সবার আগে চাই ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, এর আবশ্যিকতা সব প্রশ্নের উর্দ্ধে।।
—
তথ্যসূত্র:
১। স্মৃতি শুধু স্মৃতি নয়, আজিজ মেহের, শোভা প্রকাশ, ২০০৪।
২। বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ, অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস, অনুবাদ- মোহাম্মাদ শাজাহান, হাক্কানী পাবলিশার্স, চতুর্থ মূদ্রণ-জুলাই ২০০৬।
৩। মাওইজম ইন বাংলাদেশ : দ্য কেস অব পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি, মো. নূরুল আমিন ।
৪। বাংলাদেশে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও মুনতাসির মামুন সম্পাদিত।
৫। কোটেশন ফ্রম মাওসেতুং, রেড বুক।৬। সিরাজ সিকদার হত্যা মামলার বিবরণী, দৈনিক কালের কণ্ঠ, রাজনীতি, ৩১ মে ২০১১।
—
ছবি: সিরাজ সিকদার, আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের খোলা চিঠি, ২ মার্চ ১৯৭১, মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্টেলিন-মাও — মাওবাদীদের পোস্টর, সিরাজ সিকদার, আন্তর্জাল।
ভালো লাগল লেখা। শিরাজ শিকদারের হত্যা করেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার চরিত্র বুঝিয়ে রেখেছে। সিরাজ শিকদারের সম্পর্কে আগেও যে গুলো লেখা পড়েছি, তাকে মধ্যবিত্ত এডভেঞ্চারিষ্ট বলেই মনে হয়েছে। এমন এডভেঞ্চারিষ্টরাই ভারতের নকশালবাড়ির বিদ্রোহকেও সাময়িক ব্যর্থতাতে পরিণত করেছেন। এবং এখনো 'মাওবাদী'রা সেই পথেই হাঁটছেন। ভারত বাংলাদেশ--যেখানে গণ লাইন নেবার পর্যাপ্ত সুযোগ আছে সেখানে তাঁরা তা নিচ্ছেন না। তবে কিনা রাষ্ট্র যন্ত্র যতই মাওবাদীদের নকশাল বলুক, নকশালদের সবাই 'মাওবাদী' নয়--আর মাওবাদীদের সবাই কিন্তু নকশাল বাড়ির বিদ্রোহের সংগে ছিল না। আর মাও-ৎসে -তুঙের অনুগামী মাত্রেই 'মাওবাদী' নন...কিম্বা কেবলমাত্র দীর্ঘস্থানী গেরিলা যুদ্ধের তত্বের জন্যের মাও এতো বিখ্যাত নন। গেরিলা যুদ্ধ তো চে গুয়েভারাও করেছিলেন, বলিভিয়াতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। হো চি মিনও করেছিলেন, ভিয়েৎনামে সফল হয়েছিলেন--তবে গেরিলা যুদ্ধকে শুধু মাওএর নামের সংগে জূড়ে দেবার কারণ কি? আসলে মার্ক্স যখন আশা করেছিলেন পশ্চিমের বিকশিত পূঁজিবাদী দেশগুলো থেকেই বিপ্লব শুরু হবে, লেনিনের নেতৃত্বে বলসেভিকেরা দেখিয়েছিল, রাশিয়ার মতো পুঁজিবাদের দুর্বল ঘাঁটিতেই সেটি সম্ভব। ততোদিনে পূঁজিবাদের উত্তরণ ঘটেছে সাম্রায্যবাদে । সেই সাম্রায্যবাদের যুগে উপনিবেশগুলোতে কী হবে? এখানেও মাওএর প্রাসঙ্গিকতা। তিনি দেখান চীনের মতো আধা সামন্ততান্ত্রিক-আধা ঔপনিবেশিক দেশেও সেটি সম্ভব--এবং বিপ্লবের স্তর হবে সমাজতান্ত্রিক নয়, জনগণতান্ত্রিক। সমাজতান্ত্রিক নয় কেন না, পূঁজিবাদ এই দেশগুলোতে পূর্ণ বিকশিত নয়। সাম্রায্যবাদ এবং তার দেশীয় পূঁজিবাদী এবং সামন্তবাদী দোসরদের থেকে দেশের মুক্তিই প্রধান কাজ। এরই জন্যে মাও-ৎসে তুং গোটা দুনিয়ার তাত্বিক নেতা হয়ে উঠেন লেনিন পরবর্তী কালে। ভারত বা বাংলাদেশের কাছেও এরই জন্যে সোভিয়েত বিপ্লব থেকে চীন বিপ্লব অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক এখনো। এটা দুই লাইনের লড়াই নয়, বরং বিকশিত লাইনের প্রশ্ন। হ্যা, চীন, সভিয়েত লাইন বলে একটা কথা শোনা যেত ঠাণ্ডা লড়াইর যুগে--তার কারণ সোভিয়েত স্তালিন পরবর্তী কালে পূর্ণমাত্রাতে পুঁজিবাদী পথে হাঁটতে শুরু করে আর চীনে পুঁজিবাদের পথযাত্রীদের বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্যে তখনো মাও জীবিত ছিলেন। স্মরণ করুন লিউ সাও চি-দের বিরুদ্ধে মাও ইয়ের লড়াই। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা ইত্যাদি। তবে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কালে মাওএর সহযোগী লিন পিয়াও--পরে অতিবাম পন্থী মধ্যবিত্ত এডভেঞ্চারিষ্ট হয়ে উঠেন--যিনি এক সময় মাও-কে খুন করবারও চেষ্টা করেন--আজ যাকে আমরা মাওবাদ বলি--এগুলো আসলে লিন পিয়াও বাদ বললেই বেশি মানায়। রেডবুকের জনপ্রিয়তা আসলেই লিনপিয়াওর কারসাজী। যাই হোক, লিন পিয়াও বাদ চীন থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে গেছে। নেপালেও গেছে। কিন্তু নিজেদের মাওবাদীদের থেকে আলাদা করবার জন্যে কমিউনিষ্ট বিপ্লবীরা মাও-ৎসে-তুঙের চিন্তা ধারা বলেও আরেক শব্দগুচ্ছের ব্যবহার করেন। আসলে মাওবাদ নয়। চারুমজুমদার 'মাওবাদ' কথাটা কোনদিন ব্যবহার করেন নি। সেই মাও-ৎসে -তূঙের চিন্তাধারাই এখন গিয়ে নেপালে গিয়ে 'মাওবাদ'কে পরিশুদ্ধ করে তার লীলা দেখাচ্ছে সফলতার সঙ্গে। ভারতে গেল্ক চার দশকে মাওবাদীদের নানা ধরণের জোট গড়া এবং ভাঙ্গা ইত্যাদি হয়েছে, এখনো হচ্ছে, কিন্তু মাওবাদকে জনপ্রিয় করেছিল যারা সেই এম সি সি যে আদৌ নকশাল বাড়ির বিদ্রোহের সঙ্গে বা আসল সিপি আই এম এল গড়ে উঠবার প্রক্রিয়াতে ঐতিহাসিক ভাবে ছিল না, তার সামান্য নজির এখানে পাওয়া যাবেঃhttp://en.wikipedia.org/wiki/Maoist_Communist_Centre_of_India
ReplyDeleteমাওবাদীদের সম্পর্কে এই মূল্যায়ন একজন নকশাল পন্থীরই পড়তে পারেনঃঅনেকের কাছেই এটা বিস্ময়কর যে ভারতবর্ষের দারিদ্র্য, অপুষ্টির মাত্রা যখন সাব-সাহারান আফ্রিকাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবং অসাম্যের মাত্রা তীব্র হচ্ছে, তখনও ভারতীয় বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র টিঁকে আছে। অর্থাৎ আর্থিক উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সম্পর্ক একমুখীন ও সরলরৈখিক নয় – বরঞ্চ তার ইতিহাস অনেক জটিল। পশ্চিমের দেশগুলিতে মাথাপিছু গড় আয় ২০০০ ডলার হওয়ার পর সর্বজনীন ভোটাধিকার চালু হয়েছে, অথচ ভারতবর্ষে ১৯৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের সময় মাথাপিছু গড় আয় ছিল ২০০-২৫০ ডলার। সুতরাং এই গণতন্ত্রকে ব্যবহার করেই শ্রমিকশ্রেণি ভারতীয় রাষ্ট্রের চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল আর্থিক নীতিকে কিছুটা হলেও পিছু হঠতে বাধ্য করতে পারে, যেখানে শ্রমিকশ্রেণি সবার জন্য লড়াই করার চেতনার দিকে আরও একধাপ অগ্রসর হওয়ার স্পেস খুঁজে পাবে এবং ক্ষমতা দখলের চূড়ান্ত মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত হতে পারবে। ভারতীয় ইতিহাস, বৈচিত্র ও গণতন্ত্রের কথা মাথায় রেখে আমাদের একাজটি করতেই হবে, যতদিন না পরিস্থিতি পরিপক্ক হয় এবং তারচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই যে শ্রমিকশ্রেণির সচেতনতা, তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি ও অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যত সমাজ সম্পর্কে নতুন ধারণা তৈরির লক্ষ্যে আমাদের এই গণতান্ত্রিক সংগ্রামের শিক্ষাকে কাজে লাগাতেই হবে। ‘গ্রামসভার অনুমতি ছাড়া আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না’ – বিচারবিভাগের এই রায় আদিবাসী প্রতিরোধ সংগ্রামকে অনেক উজ্জীবিত করবে। অন্যদিকে মহেন্দ্র কার্মার কুকর্মের শাস্তি (গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেরই তার অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করা উচিত ছিল) সে পেয়েছে, কিন্তু তাতে গণ-প্রতিরোধের অগ্রগতি ঘটার ভারতীয় মাওয়িস্টদের ধারণার সাথে একমত হওয়া দুষ্কর। বরঞ্চ “আমরাই একমাত্র বিপ্লবী এবং আমরাই একমাত্র গণস্বার্থের প্রতিনিধি” – এই বোধ থেকে অপরকে নিঃশেষ করে দেওয়ার প্রবণতা বাম-বিচ্যুতির গাড্ডায় পড়ার আঁতুড়ঘর। বিপ্লবী আবেগ, ত্যাগ ইত্যাদির সাথে যদি সঠিক বিপ্লবী-তত্ত্ব বিকাশের লক্ষ্যে অনুশীলনকে পরিচালিত করা না হয়, তবে ভবিষ্যত সমাজবাদ গঠনের লক্ষ্য থেকে দল ও জনগণকে বিচ্যুত করার দায় এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সশস্ত্র সংগ্রাম যদি গণ-রাজনীতির ধারাবাহিকতা না হয়, তাহলে যা পড়ে থাকে সেটা শুধুই অস্ত্র, সংগ্রামের অন্তর্বস্তু নিঃশেষিত হয়ে যায়। কর্পোরেট হায়নাদের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধই এই রাজনীতির মুখ্য দিক। কিন্তু এই রাজনীতির মুখ্য দিশা হতে হবে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ যার অন্তে দল, গণতন্ত্র, রাষ্ট্র সবকিছুই অপ্রয়োজনীয় হয়ে নিঃশেষিত হয়ে যাবে।http://swabhimanngo.blogspot.in/2013/06/blog-post.html
ReplyDeleteসঙ্গে থাকার জন্য আবারো ধন্যবাদ। চলুক।
Deleteপুরো লেখাটা পড়েছি। আগের ধারনা থেকে বিচ্যুত হবার মতন নতুন কিছু পাইনি। বরং প্রশ্নগুলো বারও বিদ্ধ হয়েছে। হয়ত, প্রথম থেকেই সিরাজ সিকদার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারনা মাথায় বদ্ধমূল থাকার কারনেই পাল্টায়নি। একারনেই বেশ কিছু প্রশ্ন জেগেছে মনে।
ReplyDelete# ৪র্থ প্রস্তাব সম্পর্কে বলি, গোপনে কার্যরত পার্টিকে নিয়ে কেন গঠন করা হবে ‘জাতীয় মুক্তি পরিষদ’ বা ‘জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট’? জনগণই ঠিক করে কাদের/কাকে কোন দায়িত্ব দেওয়া হবে। ভারতীয় উপমহাদেশে বামপন্থী দলগুলোর সৃষ্টি মুসলিম লীগ বা আওয়ামী লীগ গঠনের বহু আগে। সেক্ষেত্রে পুরনো দল হিসেবে বামপন্থী দলগুলো সাধারণের ‘ইচ্ছা’কে ধরতে পারেনি বা বুঝতে পারেনি। নতুন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বুঝতে পেরেছে দেশের মানুষ স্বাধীনতা চায়। একারণে আওয়ামী লীগ তার মত করেই ছক সাজিয়েছে। রাজনীতি করেছে। স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে। নেতৃত্বে থেকেছে। নেতৃত্বের কাঁটা উপড়িয়েছে/ছেটেছে। যে বামদলগুলো আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেছে অতীতে, সেখানে মুক্তিযুদ্ধকালে কেন তাদেরকে নেতৃত্বে আনা হবে? মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেবার সুযোগতো তাদের কাছেও ছিল। কেন তারা কাজে লাগায়নি? মুজিব-ইয়াহিয়ার সংলাপের সময় কেন তারা অপেক্ষা করেছে? আওয়ামী লীগ রান্না করেছে, খাবার প্লেট সাজিয়েছে, এমন সময় যে কিছুই করেনি তাকে কেন খাবারের ভাগ দেবে? আর খাবারের ভাগ না পাওয়াতেই ২ মাস পর শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা, ভারতীয় ও পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (অবশ্য আগেই পাকিস্তানী ও ভারতীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল সর্বহারা)।
#আওয়ামী লীগতো বাম ঘারানার দল নয়। তাই বিপ্লবী চিন্তা ধারায় বিশ্বাসী একটা দলের মুখপাত্র হয়ে ৪র্থ ও ৫ম প্রস্তাব জনগণের কাছে কেন নিয়ে যাবে? বাম ধারার দলগুলো কি আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র/উদ্দেশ্য জনগণের কাছে বা তার পার্টির কর্মীর কাছে পৌছে দিয়েছে? ছোট্ট একটা ব্যাপার খেয়াল করুন, বামপন্থী দলগুলো তাদের সংগঠনকে ‘পার্টি’ বলে উল্লেখ করে। সিরাজ সিকদারের প্রস্তাবে কিন্তু ‘পার্টি’ হিসেবে উল্লেখ আছে। তিনি নিজের অবস্থান থেকে সরেননি। আর আওয়ামী লীগ কেন নিজ থেকে তার জায়গা সিরাজ সিকদারকে ছেড়ে দেবে?
# ‘বিক্রমপুর,মানিকগঞ্জ, পাবনা, ময়মনসিংহ উপকূলীয় এলাকা’ বেখেয়ালে একটা শব্দ ব্যবহার না করায় অর্থ পাল্টে গেছে ।
# ‘নভেম্বরের মধ্যে’ .. বহুসদস্য নিহত হয়েছিল।’.. ত্রিমুখী লড়াইয়ের ঘোষনা দিয়েছিল কারা? সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ভিন্নমতালম্বিরা নিহত হয়েছিল। আগে যে যুদ্ধ ঘোষনা করে, তার উদ্দেশ্যই থাকে বিপক্ষকে হত্যা করা। নিশ্চয়ই মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা প্রথমে হত্যাকাণ্ডর শিকার হয়। তারপরই প্রতিশোধ নিতে সিরাজ শিকদার বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করে। মুক্তিবাহিনী এখানে ভুল কিছু করেছে কি? অবশ্য মুজিব বাহিনীর জন্মই হয়েছিল যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে যুদ্ধের রাশ যেন বামপন্থীদের হাতে চলে না যায় তা নিশ্চিত করতে।
# ২৯ মে মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। আর শেষ হয় ২০ নভেম্বর। এ সময়ের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার যোদ্ধার প্রশিক্ষণ শেষ হয়। ৩ জুন সর্বহারা পার্টি নামকরণের পরই মুজিব বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষনা করে সর্বহারারা। মুজিব বাহিনীর কতগুলো ব্যাচ দীর্ঘ্যমেয়াদী প্রশিক্ষণ পায়? প্রথম ব্যাচ। আর পরেরগুলো স্বল্প মেয়াদী। এই ব্যাচগুলো যুদ্ধের ময়দানে নামতে না নামতেই সর্বহারারা তাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে দেয়। তারপরও ভাল কিছুর প্রত্যাশা করা কি ঠিক? কিন্তু এতকিছুর পরও সর্বহারাদের বিচারের মুখে দাড় করানো হয়নি। ৭৩, ৭৪ সালে ১৬ ডিসেম্বর হরতালও পালন করে সর্বহারারা। ১৬ ডিসেম্বরের পর মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র জমা দিয়েছিল। সর্বহারারা জমা দিয়েছিল কি? এসব অস্ত্র ব্যবহার করে সারাদেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছিল। এখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতা লক্ষ্য করেন, নতুন সরকার গঠনের পর সাধারণত ১ বছর সময় দেওয়া হয় তার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে। এরপর আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু ৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর অন্তত ৫ বছর সময় প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কতটা সময় দেয়া হয়েছিল? চীনে এখনও ধনী-গরীবের ব্যবধান মোছেনি, সেখানে বিজয়ের পরপরই সমতার নামে সশস্ত্র সংগ্রম চালিয়ে যাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত?
#১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মুজিব সরকারের আত্ম সমর্পণ দিবস। ... যেখানে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ৭২ এর ১২ মার্চ ভারতীয় মিত্র বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। সেখানে তার এই অভিযোগ্য সস্তা বাহবা কুড়ানোর মতন রাজনৈতিক বক্তৃতার মতন মনে হয়নাকি?৭২,৭৪ সালে ১৬ ডিসেম্বর হরতাল দেওয়াটা জামায়াতের চরিত্রের সঙ্গে কতটুকু পার্থক্য স্পষ্ট হয়?
# সিরাজ সিকদার ছিলেন চীন/নকশাল মতাবলম্বী। চীনতো মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। স্থায়ী পরিষদে দেশটির অবস্থান এখনও কেউ ভোলেনি।
সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সম্ভব অবদমিত সত্যের প্রকাশ। ধন্যবাদ বিপ্লব রহমান
ReplyDeleteসম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সম্ভব অবদমিত সত্যের প্রকাশ। ধন্যবাদ বিপ্লব রহমান
ReplyDelete