বাতাসে পোড়া লাশের গন্ধ। স্কুলের বারান্দায় সারিবদ্ধ প্রায় একশ মরদেহ সাদা প্লাস্টিকের ব্যাগে। পুড়ে কয়লা হয়ে গেছেন, ক্ষুদ্র আকৃতির হয়ে গেছেন একেকজন শ্রমিক। স্বজনরা তারপরও প্রিয় মুখটি চেনার চেষ্টায় মরিয়া। মন শক্ত করে, নাক-মুখ চেপে একেকটি ব্যাগের চেইন সরিয়ে উঁকি দিচ্ছেন তারা। রাতভর কান্না, আহাজারি, বুক ফাটা আর্তনাদের পর অনেকের চোখেই আর পানিও নেই। শুধু বোবা কান্নার শব্দ, তীব্র বেদনায় দৃষ্টি যেন ভাষাহীন।
গত রবিবার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে গিয়ে এমনই দৃশ্য দেখা গেছে। আগের দিনই [শনিবার, ২৪ নভেম্বর] পাশের তাজরিন ফ্যাশন গার্মেন্টে জীবন্ত পুড়ে ছাই হয়েছে শতাধিক শ্রমিক। নিহতদের অধিকাংশই নারী। ...
পবিত্র আশুরার ছুটি উপেক্ষা করে তথ্য-সাংবাদিকতার পেশাগত কারণে সকাল নয়টা নাগাদ পৌঁছানো গেছে ঘটনাস্থলে। একেবারে ঘটনাস্থল থেকে প্রত্যক্ষদর্শন না করলে সে বেদনার তীব্রতা বোঝা সত্যিই খুব দুস্কর। স্কুলের মাঠজুড়ে হাজারো শোকার্ত মানুষের ঢল।
শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সক্রিয় অসংখ্য সেনা, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ ও দমকল বাহিনীর সদস্য। গণমাধ্যমের কর্মীরাও তথ্য-চিত্র সংগ্রহে তৎপর। মাঝে মাঝে ভিড় ঠেলে তীব্র সাইরেনে চারপাশ সচকিত করে আসে অ্যাম্বুলেন্স। আসছে আঞ্জুমান মুফিদুলের লাশ বহনকারী ট্রাক। কখনো নিরাপত্তা সংস্থার বদলী ট্রাক। পাশের মসজিদের মাইকে দেওয়া হচ্ছে নানা নির্দেশনা।
আগুনে ভস্মীভূত গার্মেন্টের ভেতর থেকে সেদিন্ই কিছুক্ষণ আগে একে একে লাশগুলো একতলা স্কুলের বারান্দায় রাখা হয়েছে। দুর্ঘটনার শিকার স্বজনকে রাতভর এখানে-সেখানে, থানা, ক্লিনিক, হাসপাতালে কোথাও খুঁজে না পেয়ে পরিবার-পরিজন ভিড় জমিয়েছেন সেখানে। স্বজনের সন্ধানে উদভ্রান্ত নারী-পুরুষেরা নানা বয়সী। কেউ হারিয়েছেন উপার্জনক্ষম ছেলে, কেউ স্ত্রী, কেউবা মেয়ে, আবার কেউ হয়তো স্বামী। সব কান্না যেন বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায় মা সাইদুর বেগমের চাপা আর্তনাদে। ...
ব্যাগের সামান্য ফাঁক দিয়ে একটি মরদেহের মুখ দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। আঙুল উঁচিয়ে মৃতদেহটি দেখিয়ে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় একটি কথাই বারবার আর্তস্বরে বলেন, আমার ময়না মইরা গেছে গা! আমার ময়না মইরা গেছে গা!
সে করুণ দৃশ্য যেন চোখেও সয় না। পুলিশ সদস্যদেরও চোখ ভিজে ওঠে মায়ের হাহাকারে। সাংবাদিকরাও অনেকেই দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে আসে। সিনেমার আটকে যাওয়া শটের মতো যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে থাকে সময়। থেমে যায় চারপাশের কোলাহল, গুঞ্জন। শুধুই হাহাকারে অনুরিত হয় মায়ের বেদনাহত একটি বাক্য: আমার ময়না মইরা গেছে গা! ...
খানিক পরে নিরাপত্তা সংস্থার সম্মতিতে সহজেই লাশ পেয়ে যান তারা। ছয়-সাত জনের দলটির একজন পুরুষ সদস্য মরদেহের ব্যাগটি কাঁধে তুলে নিতে তখনই তারা রওনা দেন গ্রামের বাড়ির দিকে। পেছন পেছন বোধশক্তিহীন সাইদুর বেগমও ছুটে চলেন। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন স্বামী আবদুল হালিম। অল্প কথায় তিনি জানান, তাদের নিহত মেয়ের নাম পতি বেগম। বয়স আনুমানিক ষোল-সতের বছর। তার মা মেয়েটিকে আদর করে ময়না নামেই ডাকতেন। মরদেহে সোনার নাকফুলটি দেখেই তারা মেয়েকে চিনেছেন।
আরো জানা গেল, তাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তারাইলে। আবদুল হালিম নিশ্চিন্তপুরেই রিকশা চালান। পরিবার নিয়ে টিনশেডের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। পাঁচ মাস হলো পতি গার্মেন্টের চাকরিতে যোগ দিয়েছিল। মাসে তিন হাজার টাকা বেতন পেত। মেয়েকে ঘিরে বোনা তাদের সব স্বপ্ন এক রাতেই পুড়ে ছাই।...
পাথর মন নিয়ে এমনি টুকরো টুকরো অসংখ্য শোকগাথা সংগ্রহ করা হয়। মোবাইলের ক্যামেরাতে ব্যক্তিগত রেকর্ডের জন্য তোলা হয় কিছু স্থির চিত্র। একেকটি কান্নার মুখ। বেগুন পোড়া মরদেহের মুখ। স্কুলের বারান্দায় রাখা প্রায় একশ লাশের সাদা ব্যাগ। ধোঁয়ায় কালো হয়ে যাওয়া তাজরিন ফ্যাশন। আগুনের তাপে বেঁকে যাওয়া গার্মেন্টের জানালার গ্রিল। নীচ তলায় কাপড়ের ফিতার গুদাম পুড়ে ছাই। ভেতরে মেশিনপত্রের পোড়া কংকাল।
কারখানার ভেতরে তিন তলার ফ্লোরে এক জায়গায় পড়ে আছে অসংখ্য নারী-পুরুষের জুতা-স্যান্ডেল। দমকল বাহিনীর একজন পাশের ভাঙা জানালা দেখিয়ে বললেন, ওই জানালা দিয়ে লাফিয়ে ওরা বাঁচতে চেয়েছিল। অধিকাংশই বাঁচেনি। আশেপাশের একতলা টিনশেডের ঘরগুলোতেও আগুন ছড়িয়েছিল। ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে তারা সরাসরি পড়েছে আগুনের ভেতরেই। ...
পরে দেখা হয়, কারখানার ওই তিন তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে বেঁচে যাওয়া অতি সৌভাগ্যজনদের একজন নাজনীনের সঙ্গে। তার দুই হাতে মোটা ব্যান্ডেজ। বললেন সেই জীবন খেকো রাতের কথা। দোতলায় কাজ করছিলেন তিনি। আগুন লাগার খবরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখেন ধোঁয়ায় সব অন্ধকার। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। দৌড়ে ওঠেন তিন তলায়। অন্য সহকর্মীদের দেখাদেখি জীবন বাঁচাতে তিনিও ভাঙা জানলা দিয়ে ঝাঁপ দেন। বলেন, নীচে পইড়াই আমি জ্ঞান হারাইছি। পরে জাইগা দেখি, আমি ম্যালা লাশের উপরে পইড়া আছি।...
দেখা মেলে আৱো অনেক উদভ্রান্ত জন। তারা পোড়া লাশের ভীড়ে নিঁখোজদের খুঁজে ফিরছেন। কিন্তু স্বজন চিনতে পারছেন না!
স্কুলের পেছনে প্লাস্টিকের সাদা ব্যাগে বোনের আগুনে পোড়া মৃতদেহ রিকশাভ্যান চালক মাহবুব পরম মমতায় নিজের ভ্যানের ওপরে শুইয়ে দেন। শোকে-দুঃখে থর থর কাঁপুনি ধরেছে পুরো শরীরে। একটি গাছ ধরে শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখেন। জানালেন, বোন আনোয়ারা কারখানার ভেতরে আগুনে আটকা পড়েছে, একথা শুনেই তার স্বামী রিপুল ছুটে যায় তাকে উদ্ধারে। গনগনে আগুনে সহমরণ ঘটে স্বামী-স্ত্রীর। রিপুল নিজেই ওই গার্মেন্টেই কাজ করতেন। সেদিন কিছুটা আগে ছুটি মিলেছিল তার। হাতের চুরি দেখে বোনের লাশ চেনা গেছে। লাশের ভীড়ে বোনাইকে তারা খুজে পাচ্ছেন না। ...
এরপর আরো দুঃখগাথায় নোটবই ভরতে থাকে। ভাড়ী হতে থাকে করোটি। হাজার হাজার মানুষের হাহাকারে ভোঁতা হতে থাকে বোধশক্তি। নিজেকে যন্ত্রচালিত রোবট বলে মনে হয়।
বেলা চড়তে থাকলে স্কুল মাঠে একে একে আসতে থাকেন নেতা-নেত্রী। হ্যান্ড মাইকে বক্তৃতা করেন। যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চাকরি পোক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর স্তুতিবাক্য আউড়ান। ঢাকা সিটির (দক্ষিণ) মেয়রপ্রার্থী কাম এনজিও নেত্রী শিরীন আক্তার জ্বালাময়ী বক্তব্যে কুড়ান অঢেল হাততালি। পাশ থেকে একজন চিৎকার করে বলেন, কেউ হাততালি দিবেন না। আমাদের শোক চলতেছে।
আরো পরে গার্মন্টস নেত্রী নাজমা আক্তারের গলার স্বর চিরে যায় বক্তৃতারকালে। অতি ক্ষোভে, অতি আবেগে তেমন কিছুই বলতে পারেন না।
এরই মাঝে এক ফাঁকে আলাপচারিতা হয় তার সঙ্গে। তীব্র ক্ষোভ ঝরে তার কথায়, গার্মেন্ট শ্রমিকের জীবন কি এতই সস্তা? দেশের সবচেয়ে লাভজনক এই শিল্পে মালিকরা কোটি কোটি টাকা মুনাফা কামাইতেছেন। কিন্তু তারা কখনোই শ্রমিকদের মূল্যায়ন করে না। আগুন লাগলে মেইন গেট তালা মাইরা শ্রমিকদের কারখানার ভিতরে জীবন্ত পুড়াইয়া মারে। এ সবই একেকটা হত্যাকাণ্ড। তাজরীন ফ্যাশনেও তারা একই ঘটনা ঘটাইছে। আমরা আর লাশ হইতে চাই না। আমরা আর আগুনে মরতে চাই না। এমনি কইরা আর কতোজনরে মরতে হইবো? আর কতোকাল? ...তাজরীন গার্মেন্টে আগুন লাগার পর বিজিএমইএ নেতারা আইন নিয়া আসছেন। তারা শ্রম আইনের কথা বইলা নিহতদের পরিবারকে এক লাখ কইরা টাকা দেওয়ার কথা বলতেছেন। কিন্তু একজন শ্রমিকের জীবনের দাম কি মাত্র এক লাখ টাকা?
নাজমা আক্তার বলে চলেন, আমরা দাবি করছি, একজন শ্রমিক বাঁইচা থাকলে সারা জীবনে যত টাকা কামাইতো, যেভাবে তার পরিবার-পরিজনকে ভরণপোষণ করতো, তত টাকা বিজিএমইএকে দিতে হবে। নিহত শ্রমিকের পরিবারের ভরণপোষণ করতে হবে। তার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, চিকিৎসা, চাকরি -- সব দায়িত্ব বিজিএমইএকে নিতে হইবো। আর যারা আগুনে আহত হইছে, তাগোর চিকিৎসা-ক্ষতিপূরণও তারাই দিবো।
কেন বার বার এমন প্রাণহানী? এমন প্রশ্নের জবাবে গার্মেন্ট শ্রমিক নেত্রীর তড়িৎ জবাব, মালিকরা কখনোই শ্রমিকদের মূল্যায়ন করে না। বেশীরভাগ গার্মেন্ট মালিকই আইন মতো শ্রমিকদের মজুরি, নিয়োগপত্র, নিয়মিত বেতন-বোনাস, ওভারটাইম ভাতা, ছুটি, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার-- এসব কোনটাই দেয় না। তারা দম আটকানো পরিবেশে শ্রমিকদের পশুর মতো খাটায়। মালিকরা তো মনে করে, আমরা সব একেকজন চোর। যে জন্য তারা কারখানার মেইন গেইট সব সময় তালা দিয়া রাখে। আগুন লাগলেও গেট খুইলা দেয় না। আমাগো জীবন্ত অবস্থায় পুড়াইয়া মারে। এই সবই এক রকম হত্যাকাণ্ড। আর এইসব অন্যায়-অবিচার দেখার দায়ীত্ব শিল্প মন্ত্রনালয়, বাণিজ্য মন্ত্রনালয়, শ্রম মন্ত্রনালয়, পরিবেশ মন্ত্রনালয়, বিজিএমইএ'র। কিন্তু তারা কোন কাজ করে না। শুধু টাকা কামাইতে পারলেই খুশী।..
___
সংযুক্ত: আশুলিয়া-চট্টগ্রাম-নরায়ণগঞ্জ-এ গার্মেন্টস শ্রমিকদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যার প্রতিবাদে কফিল আহমেদের গান, আমারে আগুনে পুড়িয়ে মেরে।___
ছবি : দৈনিক কালের কণ্ঠ, ২৭ নভেম্বর ২০১২।
No comments:
Post a Comment