বিপ্লব রহমান ও আতাউর রহমান পিন্টু, শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) থেকে ফিরে:সরকারি নথিপত্র থেকে বেমালুম গায়েব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশাল পৈতৃক জমিদারি শাহজাদপুর তথা শাহজাদপুর ডিহি। একই সঙ্গে পুরোপুরি বেহাত হয়ে গেছে জমিদারির সম্পত্তি। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেল, ঠাকুর পরিবারের নামে এখন শাহজাদপুরের রবীন্দ্র কাছারিবাড়িটুকুই শুধু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রেকর্ডভুক্ত। বাকি জমির অধিকাংশই নানা ব্যক্তির কবজায় চলে গেছে। জমির মালিকানা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমাও রয়েছে বিস্তর।
রবীন্দ্র গবেষকরা জানাচ্ছেন, প্রাচীন শাহজাদপুর একসময় ছিল বেশ সমৃদ্ধ এলাকা। শুধু ঠাকুর পরিবার নয়, আরো অনেক জমিদারের কাছারি ছিল এই শাহজাদপুরে। যেমন- ঢাকার জমিদার রূপনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা ব্যানার্জি জমিদার, সলপের সান্যাল জমিদার, স্থলের (চৌহালী) পাকড়াশি জমিদার, পোরজনার ভাদুড়ী জমিদার ও টাঙ্গাইলের করোটিয়া চাঁদমিয়া জমিদারের ভূসম্পত্তি ছিল সেখানে।
বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার বিশাল অংশ ছিল ইসুফশাহির পরগনাভুক্ত। সে সময় ইসুফশাহি পরগনা বলতে বোঝানো হতো পাবনা জেলার সাঁথিয়া, বেড়ার একাংশ, সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর, চৌহালী, উল্লাপাড়া, কামারখন্দ ও বেলকুচি উপজেলার অধিকাংশ এলাকা, তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার অংশবিশেষ এবং ফরিদপুর জেলা। তৎকালে শাহজাদপুর শহরকে বলা হতো ডিহি শাহজাদপুর। একসময় তিন তৌজির অন্তর্গত ডিহি শাহজাদপুরের জমিদারি ছিল রানি ভবানীর মালিকানায়। কবিগুরুর পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৪০ সালে নিলামে জমিদারিটি কেনেন মাত্র ১৩ টাকা ১০ আনায়। এর সঙ্গে সঙ্গে কাছারিবাড়িটিও সে সময় ঠাকুর পরিবারের হাতে আসে। এর আগে নীলকর সাহেবরা বাড়িটির মালিক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত সাত বছর শাহজাদপুরে আসা-যাওয়া ও অবস্থান করেন। জমিদারি দেখভালের জন্য তিনি স্থায়ীভাবে থাকতেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। ১৮৯৬ সালে রবীন্দ্রনাথ শেষবারের মতো শাহজাদপুর ছাড়েন।
নথিপত্রে শুধু কাছারিবাড়ি সম্বল
বর্তমান রবীন্দ্র কাছারিবাড়িটি ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত দোতলা ভবন। বাড়িটি দৈর্ঘ্যে ২৬ দশমিক ৮৫, প্রস্থে ১০ দশমিক ২০ এবং উচ্চতায় ৮ দশমিক ৭৪ মিটার। সিঁড়িঘর ছাড়া প্রতি তলায় বিভিন্ন মাপের সাতটি করে কক্ষ আছে। ভবনের উত্তর ও দক্ষিণাংশে রয়েছে একই মাপের চওড়া বারান্দা। বাড়ির গোলাকৃতি জোড়া থামের ওপরাংশে অলংকরণ, বড়মাপের দরজা-জানালা এবং ছাদের ওপরে প্যারাপেট ও দেয়ালে পোড়ামাটির কাজ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ১৯৬৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ভবনটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে।
প্রসঙ্গত, ‘ভালবেসে সখী নিভৃত যতনে, আমার নামটি লিখ, তোমার মনেরও মন্দিরে...’ অমর এই গানসহ শতাধিক অমূল্য সাহিত্যকর্ম কবিগুরু রচনা করেছিলেন শাহজাদপুরের ওই কাছারিবাড়িতে বসে।
পৌর ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী ফজলুল হক জমিজমার প্রাচীন দলিলপত্র বহু বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। বর্ষীয়ান এই কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, একমাত্র কাছারিবাড়ির ৪ দশমিক ৬৮ একর জমিটুকু ছাড়া অন্য জমিজমার কোনোটিই ঠাকুর পরিবারের নামে সরকারি নথিপত্রভুক্ত হয়নি।
ফজলুল হক আরো জানান, ১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইনে জমিদারি প্রথা বিলোপ হওয়ার পর হিসাবমতো ঠাকুর পরিবারের জমিদারির অধিকাংশ সরকারি নথিপত্রে খাসজমিভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও আজও তা হয়নি। তবে সে সময় জমিদারির বাদবাকি জমি ও জলার পত্তনি যাঁদের নামে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের নিজ নামে রেকর্ডভুক্ত হয়েছে সেসব সম্পদ।
হদিসবিহীন জমিদারি
শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি নিয়ে কয়েক বছর ধরে গবেষণা করছেন অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত সাত বছর জমিদারির কাজে শাহজাদপুরে আসা-যাওয়া ও অবস্থান করেন। এ সময় তিনি জেলে সম্প্রদায় ও গো-খামারিদের (ঘোষ) কাছে কৃষিজমি এবং জলাভূমি পত্তনি দেন। শাহজাদপুরবাসীর আমিষ ও দুধের চাহিদা মেটাতে কবি নিয়েছিলেন এই উদ্যোগ। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ সে সময় গো-খামার গড়ে তুলতে কৃষিজমির পত্তনি দেন রাউতারা যোগেশ ঘোষের পূর্বপুরুষের কাছে। তিনি পোতাজিয়া ঘোষ পরিবার ও প্রভাবশালী হিন্দু পরিবারগুলোর মধ্যেও দেন পত্তনি।
এই রবীন্দ্র গবেষক আরো জানান, ঠাকুর পরিবারের পত্তনিপ্রাপ্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রত্যেকেই পরবর্তী সময়ে ভূ-সম্পদে সমৃদ্ধিশালী হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তাঁদের বেশির ভাগই জমিজমা বিক্রি করে পাড়ি জমান ভারতে। যে অল্পসংখ্যক পত্তনিভোগী থেকে যান, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর তাঁদের বেশির ভাগের জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। কারণ সে সময় পরিবারপ্রতি জমিজমার মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা ধরা হয়েছিল ১০০ বিঘা। সে সময় সরকার রাউতারা এবং পোতাজিয়া অঞ্চলে অধিগ্রহণ করে প্রায় দুই হাজার ৭০০ বিঘা জমি। পরে এসব জমি ইজারা দেওয়া হয় ‘মিল্ক ভিটা’কে। কিন্তু বাস্তবে এখন বেশির ভাগ জমিই জাল দলিলের মাধ্যমে বেহাত হয়ে গেছে।
হদিস নেই বিল ও জলারজমিজমার পাশাপাশি নথিপত্রে লাপাত্তা ঠাকুর পরিবারের সম্পদ আরো কয়েক শ একর বিল এবং জলাভূমি। এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল শাহজাদপুর পৌর ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী ফজলুল হক কালের কণ্ঠকে জানান, প্রাচীন নথিপত্রে ঠাকুর পরিবারের নামে একসময় পোতাজিয়া মৌজার পান্দার বিলের (প্রায় ২৩ একর) উল্লেখ আছে। এ ছাড়া বুড়ি পোতাজিয়া মৌজা ও রামকান্তপুর মৌজায় প্রায় সাড়ে ৪০০ একর জমি ঠাকুর পরিবারের সম্পদ ছিল। রবীন্দ্র কাছারিবাড়িসংলগ্ন দ্বারিয়াপুর হাটবাজার (প্রায় ছয় একর) এবং পৌরসভার পক্ষ থেকে ১৯৯৫-৯৬ সালে ভরাট করে ফেলা ছোট নদী বা খোনকারের জোলা নামে খ্যাত করতোয়া নদীর শাখা নদীটিও ছিল ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। প্রজা পত্তনিপ্রাপ্ত পান্দার বিলের প্রায় ৪৫টি জেলে পরিবারের জলাভূমি ছাড়া অন্য কোনো জমিই এখন আর এর পরিবারের উত্তরসূরিদের কাছে নেই। সবই নামে-বেনামে বেদখল হয়ে গেছে।
রবীন্দ্র গবেষক অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পান্দার বিলের ৩০০ বিঘা জমি হালদার নামক দুস্থ জেলে সম্প্রদায়ের কাছে পত্তনি দেন। এ ছাড়া তিনি নিকারি নামে পরিচিত দুস্থ ১০১ জন মুসলিম জেলের কাছে বন্দোবস্ত দেন দ্বারিয়াপুর মৌজা। জেলেদের কাছ থেকে বেহাত হওয়া এই জমি এখন দ্বারিয়াপুর মাছের বাজার নামে পরিচিত। এটি এখন পৌরসভার সম্পত্তি।
আনোয়ার হোসেনের মতে, সঠিক ভূমি জরিপের মাধ্যমে ঠাকুর পরিবারের বেহাত খাসজমিগুলো এখনো উদ্ধার করা সম্ভব।
- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2014/05/08/81653#sthash.KfXW0zh6.t2PAu51F.dpuf
No comments:
Post a Comment