Sunday, February 28, 2021

আসমা বীথিতে তিন নোক্তা~


তার ক্যামেরার চোখে আস্থা বরাবর, লেন্সে তিনি শুধু স্থির বা চলচ্ছবি ধরেন না, প্রকাশ করেন অন্তর্দৃশ্য, মুহূর্ত বা পরিস্থিতির বিবরণ, যা আসলে চলমান ইতিহাসের দিকদর্শনও।

করোনাক্রান্তিতে আসমা বীথির নির্মিত বদ্ধ সময়ের স্বল্পদৈর্ঘ প্রামাণ্যচিত্র-- 'ইনসাইড আউট' খুব ভাবিয়েছিল, যখন অপরিকল্পিত লকডাউনে বিত্তহীন মানুষের অন্নসংস্থান ছিল বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ। ওই ছবিতে ভাত-কাপড়ের রিপিটেড শটের ব্যবহার ছিল লক্ষ্যণীয়।



আর এবার "গিত্তাল মি আচ্ছিয়া" AS THE GRAIN RISES- নামক ৩৬ মিনিটের চলচ্চিত্রে বীথি উন্মোচন করেন মধুপুরে ক্ষয়িষ্ণু শালবনের ধারে চুনিয়া গ্রামে প্রাচীন প্রাকৃতিক ধর্ম "সাংসারেক" এর অনুসারী মান্দি বা গারো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিপন্ন জীবন কথা, যার কেন্দ্রে রয়েছেন মহিরুহের মতো দীপ্যমান জ্ঞানীবৃদ্ধ জনিক নকরেক।

কবি, গণসংগীত শিল্পী কফিল আহমেদ যেমন বলেন, "আধুনিক কালের আধিপত্যের মুখে প্রাকৃতজনের জীবনের অনেক গভীর সত্যই যে আজ তছনছ হয়ে গেছে। এতো কিছু হারাবার কালে মধুপুরের চুনিয়া গ্রামের একশত বিশ/বাইশ বছর বয়সী জনিক নকরেক আচ্চু আজো তাঁর প্রাকৃত সাংসারেক জীবনধারায় অটল। প্রত্যয়ী। মধুপুরের চুনিয়া গ্রামের এই প্রবীন কিংবদন্তির বিশ্বাস আর মূল্যবোধকে নিয়ে চলচ্চিত্রভাষ্য 'গিত্তাল মি আচ্ছিয়া '।"



স্বীকার করি, অনলাইনে ছবি দেখার সবচেয়ে বড় বাধা বোধহয় ফোর-জিতেও বাফারিং-এর সাফারিং, তবু চলচ্চিত্রের জমিন জুড়ে চেনা চুনিয়ার অচেনা দৃশ্যপটের জন্ম হয় কেবলই, মহাজাগতিক স্রোতের বিপরীতে বৃদ্ধ জনিক নকরেকের লাঠিতে ভর দিয়ে পা ছেচড়ে শুকনো শালপাতা মাড়িয়ে চলাই যেন ইংগিত করে প্রায় দেড়শ বছরে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত, জুম চাষ ও শিকারের ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলা, সাবেক যোদ্ধা মান্দি আদিবাসীর আধুনিক জীবনে বেঁচে থাকার অসম লড়াই।

চট্টগ্রামের "সিনে ক্লাব বিস্তার" এর আয়োজনে "বিক্ষণ ও বাহাস" পর্বে অনলাইন প্রদর্শনীর শুরুতে বীথি নিজেই বলেন ছবি নিয়ে সূচনা কথা, যা অনেকটা এরকম, আসলে সাংসারেক ধর্মটি প্রকৃতি নির্ভর ধর্ম, এই মানুষগুলো মারা গেলে এই ধর্মটিও হারিয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে প্রাচীন সংস্কৃতি, বোধ ও বিশ্বাস...ইত্যাদি।

সে দিক থেকে বিচারে এই ডকুমেন্টশনটি জরুরি, ইতিহাসের আর্কাইভ, আবার ইতিহাসের সাথে পথযাত্রাও।

ধোঁয়াশার মতো ভোরের আলোকচ্ছটা, বৃদ্ধ জনিক, আরেক সহ বৃদ্ধ, তরুণ বুদ্ধিজীবী, বন্ধুবরেষু পরাগ রিছিল, আন্তনী রেমা, জুয়েল বিন জহিরসহ বেশ কিছু টুকরো সাক্ষাৎকার, মান্দি শিশুদের দলবদ্ধ সংগীত চর্চা, 'তানা বাবা তানা ফিরিংগী দেয় হানায়' কুকুর-বেড়ালের লড়াইয়ের মন্তাজ, ঘুনে ধরা খুঁটির পাশেই চামড়া কুচকে আসা জনিক আচ্চু, শষ্য উৎসব ওয়ানগালার কিছু অনুসর্গ, বন চিরে চলে যাওয়া ঘোড়া টানা মালবাহী গাড়ি, যুদ্ধ নাচের দু-একটি দৃশ্যকাব্য আদিবাসীর জীবনাচারকে প্রকাশ করে নান্দনিক উপস্থাপনায়।



ছবিটি দেখতে দেখতে চুনিয়ার মান্দি গ্রামে বেশ খানিকটা মানসভ্রমণ হয়ে যায়, যা দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আটকে রাখে।

জনিক নকরেকের টুকরো সংলাপে নাম না জানা কোনো পাখির ডাক যেমন ন্যাট সাউন্ড হিসেবে সুন্দর মানানসই, তেমনি আন্তনী, পরাগ ও আরেকজনের সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে বাইরের কথোপকথনের ওভারল্যাপিং কখনো হাউলিং তৈরি করে, হয়তো এসবই উৎসবের অনুসংগ, তবে ডকুমেনটশনের স্বার্থেই আলাপচারিতাগুলো বোধকরি নির্জনতা দাবি রাখে, যখন তা গোবিন্দগঞ্জের সংগ্রামী সান্তলদের নিউজ ডক নয়।

ছবিতে বিপন্ন বনচারী মান্দি আদিবাসী যেমন উদ্ভাসিত, সমান্তরালে বিপন্ন বনের ছবি তেমন প্রকাশিত নয় বলেই মনে হয়েছে, বরং শাখে শাখে বানরের দোল, সবুজ শালবনবিহার, বন চিড়ে অশ্বযানের গমনাগমন বিপরীত ধারণাই যেন দেয়।

এছাড়া জুয়েলের ভাষ্যে মিশনের উদ্যোগে নাগরিক ওয়ানগালা চালুর কথা উঠে এলেও মিশন ও নগরজীবনই যে ওয়ানগালার মৃত্যুদূত সে কথা যেন প্রচ্ছন্নভাবে চাপা পড়ে যায়। এছাড়া ইদানিং চুনিয়ার ওয়ানগালার উদ্যোক্তা রুরিরা না হলেও আদিবাসী বান্ধব পাপারাই, চুনিয়াবাসী মান্দিদের এতে নিত্য অংশগ্রহণ মাত্র, এই রূঢ় সত্যও চাপা পড়ে যায় মাইকে ভেসে আসা ঢাক, শিংগা ও ঘন্টা ধ্বনিতে।
 

সংক্ষেপে, বীথির এই নির্মাণ শিল্পের জন্য শিল্প নয়, বরং শিল্পকেন্দ্রিক ইতিহাস ধারণ, মান্দি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রায় অকথিত অধ্যায়, এইখানে আদিবাসীর জয়, ব্রেভো!


ছবি নিয়ে আলাপচারিতা : 


____

সংংযুক্ত : রংচুগালা : বিপন্ন আদিবাসী উৎসব

No comments:

Post a Comment