Monday, March 16, 2015

অবহেলায় ম্রিয়মাণ বলধা গার্ডেন


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরান ঢাকার ওয়ারীর বলধা গার্ডেনের দোতলা 'জয় হাউস' নামক অতিথিশালায় কাটিয়েছিলেন দুদণ্ড সময়। বাগানের 'শঙ্খ পুকুরের' কাকচক্ষুর মতো টলটলে জল তাঁর মন জয় করেছিল। আর দুর্লভ ক্যামেলিয়া ফুলের অপার সৌন্দর্য কবিকে করেছিল বিমোহিত। 'জয় হাউসে' বসেই কবি লিখেছিলেন বিখ্যাত কবিতা 'ক্যামেলিয়া'। তবে সেসবই আজ ধূসর অতীত। অতি দর্শনার্থী আর সুউচ্চ অট্টালিকার দাপটে বিরল গাছপালার বাগানটি এখন হুমকির মুখে।

সরেজমিনে গিয়ে বাগানের 'সিবলি' (প্রকৃতির দেবী) অংশে দেখা গেছে, সংস্কারের অভাবে রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য 'জয় হাউস'-এর কড়িবর্গা, পলেস্তারা, ইট-কাঠ সবই খসে পড়ছে। মজে গেছে 'শঙ্খ পুকুর'। সেখানে নোংরা জলে ভাসছে দর্শনার্থীর ফেলা টুকরা কাগজ, চিপসের প্যাকেট, বাদামের খোসাসহ অন্যান্য বর্জ্য। নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে আবর্জনা না ফেলে দর্শনার্থীরা তা ফেলছে যত্রতত্র। এসব আবর্জনা পরিষ্কার করার মতো যথেষ্ট লোকবলও নেই বাগান কর্তৃপক্ষের। এ ছাড়া আগত যুগলরা বাগানের দুর্লভ গাছের গায়ে খোদাই করে লিখছে নিজেদের নাম। বেড়াতে আসা মানুষজন ইচ্ছামতো বাগানের ফুল-ফল, ডাল-পাতার ক্ষতি করছে।

অতিরিক্ত দর্শনার্থীর কলরব, মোবাইল ফোনে বাজানো বাংলা-হিন্দি গানসহ নানা হট্টগোলে বাগানে পাখিও বসে না। দেখা গেছে, শব্দদূষণে বিরক্ত হয়ে বিশাল চম্পাগাছের নিশাচর বাদুড়ও দিনের বেলাতেই মাঝেমধ্যে উড়ে গিয়ে স্থান বদল করছে। বৃক্ষরাজির ছোট ছোট লোহার খাঁচাতেও পড়েছে মরচে। সর্বত্রই অবহেলা-অযত্নের ছাপ প্রকট।

চারপাশের ডজনখানেক বহুতল ভবনের কারণে বাগানটিতে যথেষ্ট আলো-বাতাস খেলতে পারছে না। দিনের বেলায় গাছগুলো অধিকাংশ সময়ই থাকছে ছায়াময়। বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে গাছপালার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার। সূর্যালোকের অভাবে বাগানের কেন্দ্রে বসানো 'সূর্যঘড়ি'টিও হয়ে পড়েছে অচল। স্বর্ণ অশোক, আফ্রিকান টিউলিপ, কৃষ্ণ বট, কর্পূর, কদম, কাঠবাদাম, লতা জবা, পনিটেইল, কয়েক প্রজাতির গোলাপ বাগানসহ সবখানে মরা ডালপালা ও শুকনো পাতার জঞ্জাল।

অন্যদিকে বাগানের 'সাইকি' (আত্ম) অংশটি সংরক্ষিত বলে সেখানে নিবিড় পরিচর্যায় রয়েছে দেশি-বিদেশি দুর্লভ ৮০০ প্রজাতির প্রায় এক হাজার ৮০০টি গাছপালা। সেখানে রয়েছে উদ্ভিদ গবেষকদের জন্য বিস্তর সুযোগ। এই অংশে দেখা গেছে সাদা, হলুদসহ নানা জাতের শাপলা-শালুকের কয়েকটি হাউস, প্রায় ১০০ প্রজাতির ক্যাকটাস, অসংখ্য অর্কিডের শেড, ঔষধি বৃক্ষ ঘৃতকুমারীর একটি পৃথক শেড, ভূজ্জপত্র, বিচিত্র বকুল, আমাজন লিলি, হাঁস ফুল, গোল্ডেন শাওয়ার নামক লতা ফুল, সাদা, লাল, কমলা, নীল রঙা বাগানবিলাস, সুউচ্চ অশোক বৃক্ষসহ আরো বিভিন্ন ধরনের গাছপালা। নিরিবিলি পরিবেশে টিয়া পাখি, কাঠ ঠোকরা, শালিকসহ অন্যান্য পাখ-পাখালির উপস্থিতিও চোখে পড়ে।

এই অংশে রয়েছে একটি ছোট অফিস ঘর এবং মোট সাতজন কর্মচারীর আবাসনের ব্যবস্থা। বলধা গার্ডেন প্রতিষ্ঠাকালের (১৯০৯ সাল) দোতলা অফিস ঘরটি এখন সংস্কারহীন, ঝুঁকিপূর্ণ। দক্ষিণ সীমানায় গড়ে উঠেছে সুবিশাল একটি আবাসিক ভবন। ভবনটি আটকে দিয়েছে বাগানের দক্ষিণ দিকের আলো-বাতাস।

বলধা গার্ডেনের কর্তৃপক্ষ বন বিভাগ। রেঞ্জ কর্মকর্তা বশির আহমেদ অকপটে বাগানের অব্যবস্থাপনার কথা স্বীকার করেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, "একে সুবিশাল অট্টালিকার ছায়ায় বাগানের গাছপালার স্বাভাবিক বিকাশ রক্ষা করাই কঠিন, এরপর রয়েছে অসংখ্য দর্শনার্থীর উৎপাত। তারা যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। বাগানের ফুল-ফল নষ্ট করছে। বাগান পরিচর্যার জন্য আমাদের যথেষ্ট লোকবল নেই। পরিকল্পনার অভাবে 'জয় হাউস'টি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত। অর্থাভাবে 'শঙ্খ পুকুর' সংস্কার হচ্ছে না। সেখানকার পানি বদলে আমাজন লিলিসহ কয়েক ধরনের শাপলা-শালুক রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।"

বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, বলধা গার্ডেন শুধু একটি ঐতিহাসিক বাগানই নয়, এটি একটি ঐতিহ্য ও জাতীয় সম্পদ। একে রক্ষা করা সরকার ও পরিবেশবিদদের অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু দেখা গেছে, গত কয়েক দশকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বাগানটি রক্ষা করার কথা ভাবেনি। তাই তারা এর চারপাশে বহুতল ভবন গড়ার অনুমতি দিয়ে বাগানটি নষ্ট করার উপক্রম করেছে। তবে এখনো সময় আছে। প্রকৃতিপ্রেমী ও পরিবেশবিদদের কর্তব্য হবে বাগানটি রক্ষা করার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। একে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করা। তিনি বলেন, অন্যদিকে বাগানটিকে রক্ষা করা ও এর দেখভালের দায়িত্ব প্রধানত বন বিভাগকেই নিতে হবে। তাদের উচিত হবে সেখানে দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রণ করা। এককথায়, বলধা গার্ডেন রক্ষায় যা কিছু প্রয়োজন তার সবই বন বিভাগকে করতে হবে।

একনজরে বলধা গার্ডেন : ১৯০৯ সালে গাজীপুরের বলধার জমিদার, বিশিষ্ট প্রকৃতি প্রেমিক নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন এই উদ্ভিদ উদ্যান। প্রায় ৩ দশমিক ৩৮ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত বাগানটি 'সাইকি' ও 'সিবলি' নামক দুটি অংশে বিভক্ত। গ্রিক পৌরাণিক শব্দ 'সাইকি'র অর্থ আত্মা। আর 'সিবলি'র অর্থ প্রকৃতির দেবী। বাগানটিকে সমৃদ্ধ করতে সে সময়ই তিনি দেশ-বিদেশের বহুসংখ্যক নামিদামি গাছ সংগ্রহ করেন। ১৯৪৩ সালে জমিদারের মৃত্যুর পর কলকাতা আদালতের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হতে থাকে একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে। ১৯৬২ সালে বন বিভাগকে দেওয়া হয় বলধা গার্ডেনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব। এখন বাগানটি মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের একটি স্যাটেলাইট অংশ।
__
ছবি: রফিকুর রহমান রেকু

মজে যাওয়া 'শঙ্খ পুকুর'। এর পানিতে ভাসছে দর্শনার্থীদের ফেলে দেওয়া টুকরা কাগজ, চিপসের প্যাকেট, বাদামের খোসাসহ অন্যান্য বর্জ্য। ছবি : রফিকুর রহমান রেকু - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/news/2015/03/16/199191#sthash.BUKcO8n9.dpuf
- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/news/2015/03/16/199191#sthash.BUKcO8n9.dpuf

No comments:

Post a Comment