Wednesday, May 4, 2016

পরাজিত হন না সাত্তার

বিপ্লব রহমান, ঢাকা: ১৯৭১-এ যুদ্ধ জয় করেছিলেন আব্দুস সাত্তার সালাউদ্দীন (৬০)। আর স্বাধীন দেশে তিনি আরো একবার কঠিন যুদ্ধে জয়ী হলেন। পাঁচ বছর আমলাতন্ত্রের লালফিতার সঙ্গে লড়াই করে চট্টগ্রামের কন্টেইনার ডিপো থেকে মুক্ত করলেন তার বিশ্বভ্রমণের গাড়িটি।

বুধবার (৪ মে) চট্টগ্রাম থেকে টেলিফোনে বিশ্ব পর্যটক আব্দুস সাত্তার নিউজনেক্সটবিডি ডটকম-এর সঙ্গে আলাপকালে এই তথ্য জানান। মঙ্গলবার গভীর রাতে চট্টগ্রামের কন্টেইনার ডিপো থেকে তার গাড়িটি ছাড় করানো সম্ভব হয়েছে। এই গাড়িতেই (মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার, ২০০৬ সাল, রেজিস্ট্রেশন-বিবিবিবি ৯৩৫) লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে বিশ্বভ্রমণ করে গিনেজ বুকে নাম লেখানোর স্বপ্ন তার।

আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘গাড়িটি ছুঁয়ে যেন আমি আমার স্বপ্নই ছুঁয়ে দেখছি। সামান্য মেরামত করিয়ে নিয়ে আবার আমি বেরিয়ে পড়বো পৃথিবীর পথে। আর গাড়িটি ছাড় করানোর জন্য যে পাঁচ-পাঁচটি বছর আমার জীবন থেকে ঝরে গেছে, সে জন্য কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। সবই কপালের ফের।’

বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে আবদুস সাত্তার কানাডার টরন্টো থেকে সড়কপথে বিশ্বভ্রমণে বের হন ২০০৯ সালের ২ আগস্ট। এরই মধ্যে তিনি অনেকটা নির্বিঘ্নে পাড়ি দিয়েছেন ২২টি দেশ। একই গাড়িতে শদুয়েক দেশ পরিভ্রমণ করে বিশ্বরেকর্ড গড়ার ইচ্ছে তার। সে যাত্রায় পাকিস্তানে পৌঁছে করাচি স্থলবন্দর থেকে গাড়িটি তুলে দেন কনটেইনারে। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গাড়িটি নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়া।

২০১০ সালের ২৯ মে বাংলাদেশে পৌঁছেন সাত্তার। আর তখন থেকেই আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে সেখানেই আটকে যায় তার গাড়িটি। যানটিকে ছাড় করানোর জন্য পাঁচ বছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও সরকারি কর্তাদের টেবিল থেকে টেবিলে হন্যে হয়ে ঘুরেছেন তিনি। প্রায় ১৪ লাখ টাকা গচ্চা দিয়ে হয়েছেন সর্বস্বান্ত। নিভৃতে গলা ছেড়ে কেঁদেছেন অনেক তাই বলে হাল ছাড়েননি, পরাজয় মেনে নেননি।

‘এই পাঁচ বছরে আমার হয়রানির কথা লিখতে গেলে বিশাল এক বই হয়ে যাবে। বহু ফিস দিয়েছি, আবেদন করেছি, এমনকি নীতিবিরুদ্ধভাবে নানা টেবিলে ঘুষও দিয়েছি। টানা তিন বছর উত্তরায় এক মেয়ের বাসায় গলগ্রহ হয়ে ছিলাম। এখন দয়াগঞ্জে এক শুভাকাঙ্ক্ষীর বাড়ির ছাদের ঘরে রাত কাটাই। সামান্য শাকান্ন জোটে তারই অনুগ্রহে। তবু কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই’, বলেন আব্দুস সাত্তার।

আবারো বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ার স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, এখন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তার স্পন্সর হওয়ার জন্য খুঁজছেন। আর যে প্রতিষ্ঠান তার স্পন্সর হবে, সে কোম্পানি বা তাদের পণ্যের ছবি ওই গাড়ির বোর্ড হিসেবে ব্যবহার করবেন সাত্তার।

এছাড়া বিশ্বভ্রমণে গাড়িটি যেখানে পার্ক করবেন তিনি, সেখানে ওই পণ্যের বোর্ড দিয়ে পুরো গাড়িটি ঘেরা থাকবে, এভাবেও স্পন্সরের প্রচার হবে। আব্দুস সাত্তারের মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার গাড়ি, এই যানেই বিশ্বজয় করবেন তিনি।

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি তাকে বলেছি, বিশ্ব ভ্রমণ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদর্শনীতে ব্যবহারের জন্য গাড়িটি দিয়ে দেবো। তাতেও স্পন্সরের বিজ্ঞাপন হবে’, বলেন আব্দুস সাত্তার।



আমলাতন্ত্রের সুলুক সন্ধান আবদুস সাত্তারের দীর্ঘতম হয়রানির বয়ানটি সংক্ষেপে এ রকম- বাংলাদেশে পৌঁছে ২০১০ সালের জুনে তিনি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গাড়িটি ছাড় করানোর জন্য যান কমলাপুর আইসিডির শুল্ক কর্মকর্তার দপ্তরে। সে সময় তাকে বলা হয়, আমদানি-রপ্তানি (চিফ কন্ট্রোলার অব ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট) দপ্তরের প্রধান নিয়ন্ত্রকের ছাড়পত্র প্রয়োজন।

২২ মে প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে গেলে জানানো হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে। আড়াই মাস বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ধর্ণা দিয়ে ১১ আগস্ট মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পান তিনি। পরে প্রধান নিয়ন্ত্রকের ছাড়পত্র নিয়ে ১৮ আগস্ট যান চট্টগ্রাম শুল্ক কার্যালয়ে। এবার শুল্ক বিভাগ জানায়, রাজস্ব অধিদপ্তরের (এনবিআর) ছাড়পত্র লাগবে। এনবিআর কর্মকর্তারা গাড়িটির দাম ধরে ব্যাংক গ্যারান্টি জমা দিয়ে ছাড় করানোর পরামর্শ দেন। সাত্তার আবার যান চট্টগ্রাম শুল্ক বিভাগে। সেখান থেকে তাকে জানানো হয়, গাড়িটি ছাড় করাতে প্রয়োজন এক কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি। কিন্তু তিনি এত টাকা পাবেন কোথায়?

আবার শুরু হলো গ্যারান্টি মওকুফের জন্য ধর্ণা। কিন্তু কিছুতেই যেন শেষ হয় না তার হয়রানির। এমনই দৌড়ঝাঁপের ভেতর গণমাধ্যমের নজর কাড়েন মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার। গত পাঁচ বছরে তাকে নিয়ে অনলাইন নিউজ পোর্টোল, সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে একাধিক বিশেষ প্রতিবেদন। সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বছর চারেক আগে তার সমর্থনে মানববন্ধন করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আবেদন, একাধিক মন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ ইত্যাদি পর্বও সেরেছেন। তবু শিকে ছেঁড়েনি। সরকারের বিভিন্ন অধিদপ্তরের বক্তব্য, ভ্রমণের জন্য এক দেশ থেকে আরেক দেশে গাড়ি নিতে হলে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। এই ‘কারনেট দি প্যাসেজ’ থাকলে বিনা শুল্কে এক দেশ থেকে আরেক দেশে গাড়ি নেয়া যায়। এই অনুমতি নেননি সাত্তার।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কানাডায় থাকতে বিষয়টি আমার জানা ছিল না। অন্য কোনো দেশও এটি চায়নি। এমনকি ২০১২ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে জানানো হয়েছিল, এ ক্ষেত্রে ‘কারনেট দি প্যাসেজ’ লাগবে না। বাংলাদেশ অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের সুপারিশপত্র নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলেই গাড়িটি ছাড়পত্র পাবে। অনেক কষ্টে সেই সুপারিশপত্র জোগাড় করে ওই বছরের জুন-জুলাইয়ের দিকে আবেদন করি চট্টগ্রাম শুল্ক বিভাগের তৎকালীন উপকমিশনার মাহমুদুল হাসানের কাছে। সেই থেকে আমার নথিপত্র ওই কর্মকর্তার টেবিলেই পড়ে ছিল। এরই মধ্যে উপকমিশনারসহ পদস্থ অনেক কর্মকর্তাই বদলি হয়ে গেছেন।’

সবশেষ আব্দুস সাত্তারকে নিয়ে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে এই প্রতিবেদকের সংবাদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের নজর কাড়ে। নতুন করে আবার সব নথিপত্র উর্ধ্বদিকে ধাবিত হয়। পাশাপাশি একই বছর শেষ কপর্দক ৭৪ হাজার টাকা দিয়ে গাড়িটির বীমা করান আবদুস সাত্তার। সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মনোয়ারা খানম ওইবছর এপ্রিলে তার পক্ষে রিট আবেদন করেন। আর এভাবেই নতুন করে লড়াইয়ে নেমে আমলাতন্ত্রকে পরাজিত করেন সাত্তার।


নিউজনেক্সটবিডি ডটকম/বিআর/এফআর




http://bangla.newsnextbd.com/article235344.nnbd/

No comments:

Post a Comment